November 1, 2024, 10:32 pm
জাহিদুজ্জামান/
কুষ্টিয়া হাইস্কুলের ঐতিহ্যবাহী খেলার মাঠটি এক বছরের বেশি সময় ধরে পুলিশ নারী কল্যান সমিতির বাণিজ্য মেলার জন্য স্থায়ীভাবে দখলে ছিলো। প্রতিবছর প্রশাসন কিংবা বেসরকারি উদ্যোগে এখানে চলে বাণিজ্য মেলার আয়োজন। এজন্য পুরো মাঠ ঘিরে নিয়ে তৈরি করা হয়েছিল স্থায়ী স্থাপনা। স্কুল কর্তৃপক্ষ এবং মেলা আয়োজকদের এই বাণিজ্যিক চিন্তায় খেলাধূলা হারিয়ে গেছে এ মাঠ থেকে। কিশোর-যুবাদের খেলার জন্য মাঠটি পুরোপুরি খেলার উপযোগী করে দেয়ার দাবি জানিয়েছেন স্কুলের সাবেক শিক্ষার্থী এবং সচেতন নাগরিকরা। স্কুল কর্তৃপক্ষ বলছে অচিরেই মাঠটি ফাঁকা করে খেলার উপযোগী করে দেয়া হবে।
কুষ্টিয়া শহরের প্রাণকেন্দ্রে নবাব সিরাজউদ্দোলা সড়কের পাশেই অবস্থিত কুষ্টিয়া হাইস্কুল। ১৮৬১ সালে প্রতিষ্ঠিত এই স্কুলের সাথে আছে বিশাল খেলার মাঠ। সাবেক শিক্ষার্থী এবং ক্রীড়া সংগঠকরা বলছেন, মাঠটি খেলোয়াড় তৈরির সূতিকাগার ছিলো। কুষ্টিয়া থেকে যারা জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ভাল খেলার সুযোগ পেয়েছেন যারা তারা সবাই এই মাঠে প্রাকটিস করতেন। ঐতিয্যবাহী এই মাঠে গত ১৮-২০ বছর ধরে আয়োজন করা হয় বাণিজ্য মেলাসহ বিভিন্ন মেলার। কিন্তু ২০২০ সাল থেকে বাণিজ্য মেলার জন্য মাঠটি স্থায়ীভাবে দখলে নিয়ে নেয় মেলার আয়োজকরা। গতবছর মার্চে এই মাঠে বাণিজ্য মেলা শুরু হয়েছিল। কিন্তু করোনাভাইরাস মহামারী শুরু হলে তা বন্ধ হয়ে যায়। এরপর থেকে খেলার মাঠ মেলার মাঠ হিসেবে দখলে আছে। একইসঙ্গে বিভিন্ন মার্কেট নির্মাণের কারনে মাঠটি কিছুটা সংকোচিতও হয়েছে। কুষ্টিয়া হাইস্কুলের মাঠে পুরোটাই মেলার স্ট্রাকচার হিসেবে ছিলো। টিনের বেড়া দিয়ে ঘেরা মাঠ। বাঁশের তৈরি মেলার স্টল। বিভিন্ন জায়গায় এখনো পড়ে আছে ইট, কাঠ, বাঁশ এবং লোহার গাদা। বোঝার কোন উপায়ই নেই এটি একটি খেলার মাঠ। মাঝখানে ৬/৭ তলা উচ্চতার লোহার তৈরি বিশাল টাওয়ার ছিলো। খুলে ফেলা হলেও তার পাটাতন এখনো রয়েছে। প্রায় পুরো মাঠ জুড়েই বিছানো ইট। তৈরি করা হয় যাতায়াতের রাস্তা। পাকা ভবনের সামনে রয়েছে পুলিশ কন্ট্রোল রুমের সাইনবোর্ড। এরমধ্যেই কিছু যুবকের আনাগোনা দেখা যায়। বিভিন্ন পয়েন্টে ছিরো পুনাক বাণিজ্য মেলা ২০২০ এর সাইনবোর্ড। এখনো রয়েছে একটি। রয়েছে বিদ্যুত সংযোগের খুটি ও তার। পানির ফোয়ারার জন্য স্থায়ী স্থাপনা তৈরি করা হয়েছে। কোথাও কোথাও টাইলসও বসানো হয়েছে। ফুটবল খেলার জন্য প্রস্তুত করা মাঠের গোল পোস্টও কোনমতে দাড়িয়ে আছে। সেখানেও গাদা দিয়ে রাখা আছে বাঁশ। গত বছরের শুরুতে এই মাঠে মেলার আয়োজন করতে এসব স্থাপনা বসানো হলেও তা এতোদিন অপসারণ করা হয়নি।
তবে, গত ২৭ মার্চ থেকে মালামাল সরিয়ে নেয়ার কাজ শুরু হয়। দুই দিনে চারিদিকের টিনের প্রাচীর খুলে ফেলা হয়। বাঁশ-কাঠের তৈরি স্টলগুলোও ভেঙ্গে ফেলা হয়। খুলে ফেলা হয় বিশাল টাওয়ার। এর কিছু মালামাল নিয়ে গেলেও বাকী সব মাঠের মধ্যেই স্তুপ করে রাখা আছে। এখন এরই ফাঁকে যে জায়গা তৈরি হয়েছে সেখানেই খেলছে শিশু-কিশোররা। সারা মাঠে নির্মাণ সামগ্রি এবং ইট থাকায় খেলতে আসা শিশু-কিশোররা আঘাত পাচ্ছেন।
এসব মালামাল, পাকা স্থাপনা এবং বিছানো ইট সরাবে কি-না তা নিয়ে চিন্তিত স্কুল কর্তৃপক্ষ। কুষ্টিয়া হাইস্কুলের অধ্যক্ষ খলিলুর রহমান বলেন, এগুলো সরাতে অনেক অর্থের প্রয়োজন। তারা না সরালে আমরা কী করতে পারি।
কুষ্টিয়া জেলা দলের খেলোয়াড় ছিলেন তাজুল ইসলাম বাবু। তিনি স্মৃতিময় এই কুষ্টিয়া হাইস্কুলের মাঠ দেখে হতাশা প্রকাশ করেন। তাজুল ইসলাম বলেন, এই মাঠে অনেক খেলেছি। এখন সেই মাঠ কই? এখানে দেখছি মেলার আয়োজন। মেলার সময় লটারী এবং জুয়ার কারণে কুষ্টিয়া শহরে বসবাস করাই কঠিন হয়ে যায়। মাইকে ভয়াবহ শব্দ দূষণ হয়। বাবু বলেন, এখানে মাদকেরও আড্ডা বসছে। আমি দ্রুত এসবের দ্রুত উচ্ছেদ চাই, যেন খেলার মাঠ আগের মতো হয়, নতুন প্রজন্ম যাতে এখানে খেলার সুযোগ পায়।
স্থানীয় দু’যুবক মাঠের আশপাশেই ঘুরছিলেন। এদের একজন শরীফুল ইসলাম বলেন, খেলাধূলা করতে পারছি না মেলার কারণে। একবছরের বেশি সময় মেলার এসব জিনিস রাখা। বাইরের ছেলেরা এসে এখানে মাদক সেবন করে। আমরা খেলার সুযোগ পাচ্ছি না। দ্রুত এসব সরিয়ে খেলার পরিবেশ সৃষ্টির দাবি জানান শরীফুল। শরীফুলের বন্ধু বলেন, বিকেলে এখানে শত শত কিশোর যুবক খেলতে আসতো। এখন আসে মাদক সেবন করতে। আমরা এখানে খেলতে পারছি না।
ক্রীড়া সংগঠক সাব্বির মোহাম্মদ সবু বলেন, এই মাঠটি ছিলো কুষ্টিয়ার খেলোয়াড়দের প্রাণকেন্দ্র। এখানকার যেসব খেলোয়াড় জাতীয় পর্যায়ে খেলেছেন তাদের সূতিকাগার ছিলো এই মাঠ। ছোট বেলা থেকেই এই মাঠে খেলার জন্য অপেক্ষা করতাম, বড় ভাইদের প্রাকটিস শেষ হলে আমরা একটু সুযোগ পেতাম। কিন্তু এই মাঠ এখন কষ্টের জায়গা। মাঠের যে দুর্দশা তা খুবই ব্যাথিত করে। এই মাঠ এখন দেখলে মনে হয় এটি খেলার নয়, মেলারই মাঠ। এখানে মেলাই হবে এমন একটি অলিখিত নিয়ম হয়ে গেছে যেন। রাস্তা নির্মাণ করা হয়েছে, হাজার হাজার ইট ফেলে রাখা হয়েছে। সব ইট তুলে ফেলতে হবে। একদম আগের মতো করে দিতে হবে মাঠ- দাবি করেন তিনি।
কুষ্টিয়া নাগরিক কমিটির সদস্য এসএম কাদেরী শাকিল বলেন, এই কুষ্টিয়া হাইস্কুলকে ইউনাইডেট হাইস্কুলও বলা হয়। এটি দীর্ঘদিনের পুরাতন। এই স্কুলে আমিও লেখাপড়া করেছি। স্কুলের যে সুন্দর পরিবেশ ছিলো বাণিজ্যিকীকরণের কারণে সেটি নষ্ট করে ফেলেছে। হাইস্কুল ঘিরে মার্কেট-দোকানপাট তৈরিসহ বাণিজ্যিক কাজেই শিক্ষকরা ব্যস্ত। লেখাপড়ার মান কমে যাচ্ছে। প্রধান শিক্ষকের নামে দুদকে অবৈধ অর্থ উপার্জনের মামলা হয়েছে। আমরা চাই এর সুষ্ঠু তদন্ত হোক, যারা দোষী তাদেরকে শাস্তি আওতায় আনা হোক। এই হাইস্কুলের যে বিশাল মাঠ সেখানে ১৯৭২-৭৩ সালে আমি নিজে খেলেছি বলেন শাকিল। বাংলাদেশের সেরা সেরা খেলোয়াড়রা এই মাঠে খেলেছেন। এখানে খেলেই কুষ্টিয়ার অনেক খেলোয়াড় তৈরি হয়েছে। কিন্তু এই খেলার মাঠিটিও বাণিজ্যিকীকরণ করেছে স্কুল কর্তৃপক্ষ। প্রতিবছর তারা মেলার নামে জুয়া খেলাসহ নানা অবৈধ কর্মকাণ্ডে মাঠটি নষ্ট করে ফেলছে। মাঠের মধ্যে দোকানঘর, গোডাউন বানানো হয়েছে। স্কুলের প্রাক্তন ছাত্র হিসেবে আমার দাবি মাঠটি রক্ষা করা হোক। খেলার জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হোক। শাকিল বলেন, খেলাধূলা নেই বলে আজ আমাদের যুব সমাজ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে যুক্ত হচ্ছে। এ কারণে আমার জোর দাবি এই মাঠটি যেন শুধু খেলার মাঠ হিসেবেই রাখা হয়। সব কিছু অপসারণ করে যেন কোমলমতি শিশু-কিশোরদের জন্য খেলার মাঠটি ফিরিয়ে দিতে প্রশাসনের প্রতি আহ্বান জানান তিনি। তিনি বলেন, ক্রিড়া ও সংস্কৃতি ক্ষেত্রে কুষ্টিয়ার ছেলে-মেয়েরা অনেক এগিয়ে ছিলো, এই মাঠ উন্মুক্ত করে দিলে তারা আবার ফিরে আসতে পারবে।
মোবাইল ফোনে কথা হয় কুষ্টিয়া হাইস্কুলের অধ্যক্ষ খলিলুর রহমানের সঙ্গে। সাংবাদিক জাহিদুজ্জামানকে তিনি বলেন, মাঠটি দ্রুতই উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে। এটি পুলিশ নারী কল্যান সমিতির নামে মেলার জন্য বরাদ্দ নিয়েছিলেন জাহাঙ্গীর আলম বাদশা নামের এক ব্যাক্তি। তাকে মেলার মাঠ থেকে সব খুলে নিয়ে যেতে বলা হয়েছে। তিনি মালামাল সরিয়ে নেয়ার কাজ শুরু করেছেন। টাওয়ার খুলে ফেলা হয়েছে। সবকিছু সরিয়ে খেলার জন্য প্রস্তুত করতে সময় লাগবে- সাংবাদিককে জানান অধ্যক্ষ।
এ ব্যাপারে কথা হয়, কুষ্টিয়ার পুলিশ সুপার খাইরুল আলমের সঙ্গে। সাংবাদিক জাহিদুজ্জামানকে তিনি বলেন, গতবছর মেলার সময় তিনি কুষ্টিয়া ছিলেন না। সেসময় কীভাবে বরাদ্দ দেয়া হয়েছিল তা জানা নেই। এসপি বলেন, পুলিশের নামে কোন মেলা বরাদ্দ নেয়া হয়না। আর করোনার কারণে এখন নতুন করে কোন মেলার অনুমতিও দেয়া হবে না। তাই মাঠ উন্মুক্ত করতে স্কুল কর্তৃপক্ষকেই উদ্যোগ নেয়ার কথা বলেন তিনি। এসপি বলেন, পুরোপুরি উচ্ছেদ করতে প্রয়োজনে জেলা প্রশাসককে চিঠি দিতে পারেন স্কুল কর্তৃপক্ষ।
এদিকে মেলার বরাদ্দ নেয়া জাহাঙ্গীর আলম বাদশা বলেন, মালামাল সরানো শুরু হয়েছে। আমার যতো লোকসান হোক সব সরিয়ে দেবো। আগামী রোজার মধ্যে এ কাজ শেষ করবেন- সাংবাদিক জাহিদুজ্জামানকে বলেন তিনি।
Leave a Reply